সৃষ্টির শুরুতেই আমরা ঈশ্বরের কণ্ঠে শুনি সেবার সুর। সবকিছু সৃষ্টি করার পর ঈশ্বর মানুষকে সবকিছুর ওপর প্রভুত্ব করার তথা সবকিছু দেখাশুনা ও যত্ন করার দায়িত্ব দিলেন ৷ এরপর আমরা দেখি, ঈশ্বর মোশীর মধ্য দিয়ে যে-দশ আজ্ঞা দিয়েছেন সেই আজ্ঞাগুলোর মূলকথাটি হলো ভালোবাসা। তিনি বলেন, “প্রধান আদেশটি হলো এই: ‘শোন, ইস্রায়েল : আমাদের ঈশ্বর প্রভুই একমাত্র প্রভু! আর তোমার ঈশ্বর স্বয়ং প্রভু যিনি, তাঁকে তুমি ভালোবাসবে তোমার সমস্ত অন্তর দিয়ে, তোমার সমস্ত প্রাণ দিয়ে, তোমার সমস্ত মন দিয়ে আর তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে।' দ্বিতীয় প্রধান আদেশটি হলো এই: ‘তোমার প্রতিবেশীকে তুমি নিজের মতোই ভালোবাসবে” (মার্ক ১২:২৯-৩১)।
গুরুর আদেশে শিষ্যগণ সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁদের হৃদয়ে যে ঢেউ উঠেছিল তা এসে পড়লো বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে (সে সময়কার পূর্ববঙ্গ) চারশত বছরেরও আগে খ্রিষ্টমণ্ডলী স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে মণ্ডলী নানাবিধ সেবাকাজে জড়িত হয়েছে। সেই সেবাকাজগুলোর কিছু কিছু নিচে তুলে ধরা হলো :
১। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে : ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে অনেক খ্রিষ্টান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনজন পুরোহিতসহ তাঁদের অনেকে শহিদ হয়েছেন। অনেক সাধারণ মানুষও প্রাণ দিয়েছেন। বহু লোকের ঘরবাড়ি পাকিস্তানিরা পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিশপগণ পুরোহিতদেরকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যেন তাঁরা যুদ্ধে আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দান করেন। অনেক ধর্মপল্লীতে লোকদের আশ্রয় দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেছেন । অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবাশুশ্রষা করেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
২। শিক্ষাক্ষেত্রে : বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী শিক্ষার দিকে জোর দিয়েছেন প্রচুর। কারণ মণ্ডলী উপলব্ধি করেছে, একটা জাতিকে উন্নত করতে হলে শিক্ষার আলো ছড়াতে হবে আগে। তাই তাঁরা দেশের বহু স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহরে, তেমনি হয়েছে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। সারা দেশে বর্তমানে মণ্ডলী পরিচালিত প্রাইমারি স্কুল রয়েছে ৫১৩টি, জুনিয়র হাই স্কুল ১৪টি, হাই স্কুল ৪৮টি, কলেজ ৫টি, কারিগরি বিদ্যালয় ১৩টি, শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল ১২৫টি।
খ্রিষ্টমণ্ডলী বাংলাদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। খ্রিষ্টমণ্ডলী কর্তৃক পরিচালিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধর্মানুসারী শিক্ষার্থীই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। নিম্নলিখিত কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা যথেষ্ট উচ্চমানের :
(১) প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়;
(২) শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি নজর দেওয়া হয়, নিজেদের কোনো লাভের দিকে নয়;
(৩) সব বিষয় ভালো করে পড়ানো হয়;
(৪) সুন্দর জীবনগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া হয়;
(৫) পরিচালকমণ্ডলী এসব কাজে জীবন উৎসর্গ করেন। শিক্ষার্থীদের সেবা করে তাঁরা ঈশ্বরকেই সেবা করেন।
(৬) নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ পরিচালকদের পরিচালনা।
এসব কারণে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান ভালো হয়।
৩। স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে: স্বাস্থ্যের উপর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নতির অনেক কিছু নির্ভর করে। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মানুষের শিক্ষায় যেমন মন বসে না তেমনি অন্য কোনো কিছুই ভালো লাগে না। তাই খ্রিষ্টমণ্ডলী চিকিৎসাকেন্দ্রের উপর অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সারা দেশে খ্রিষ্টানদের বড় বড় হাসপাতালগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো অন্যতম : দিনাজপুর সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতাল, খুলনার মংলায় সেন্ট পৌল হাসপাতাল, যাশোরে ফাতেমা হাসপাতাল, রাজশাহী খ্রিষ্টান হাসপাতাল, নাটোরের হরিশপুর হাসপাতাল, নাটোরের মিশন হাসপাতাল, কক্সবাজারের মালুমঘাট খ্রিষ্টান হাস- পাতাল, চন্দ্রঘোনা খ্রিষ্টান হাসপাতাল, পার্বতীপুর ল্যাম হাসপাতাল, টাঙ্গাইলের মধুপুরে জলছত্র হাসপাতাল ও জলছত্র কুষ্ঠাশ্রম, দিনাজপুরের ধানজুরি কুষ্ঠ হাসপাতাল, ফরিদপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ পরিচালিত কুষ্ঠাশ্রম, নটর ডেম নেভিন হাসপাতাল, ঢাকা খ্রিষ্টান হাসপাতাল, সেন্ট মেরী'স কাথলিক মা ও শিশু সেবাকেন্দ্র। এগুলোর মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টান-অখ্রিষ্টান, ধনীগরিব সব মানুষের জন্য চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালও খ্রিষ্টান মিশনারীদের দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু পরে তা রেড ক্রিসেন্টের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিসপেন্সারি: খ্রিষ্টানদের পরিচালিত ৬৫টিরও অধিক ডিসপেন্সারি রয়েছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে প্রতিদিন অগণিত রোগীদের বিনামূল্যে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে ঔষধসহ চিকিৎসা দেওয়া হয়। এদের বেশিরভাগগুলোতেই স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়।
ডাক্তার ও নার্স: ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় সারা দেশে ১২০ জনের অধিক খ্রিষ্টান ডাক্তার ও পাঁচ হাজার জনেরও অধিক খ্রিষ্টান নার্স বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
৪। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে: বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। কারিতাস, সিসিডিবি, কৈননিয়া, খ্রিষ্টান ক্রেডিট ইউনিয়ন, কাল্ব, খ্রিষ্টান হাউজিং সোসাইটি, সালভেশন আর্মি, ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং এ ধরনের আরও অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছে।
৫। যুব উন্নয়ন ক্ষেত্রে: যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলে দেশ সুপথে চলবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। এ-কারণে যুবসমাজকে সুগঠন দেওয়ার জন্য আমাদের দেশের সাতটি ধর্মপ্রদেশে সাতটি যুব কমিশন ও একটি জাতীয় যুব কমিশন রয়েছে। এর দ্বারা যুবক-যুবতীদেরকে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো হয়।
৬। পরিবার উন্নয়ন ক্ষেত্রে : পরিবার থেকেই মানুষ ভালোবাসা, ন্যায্যতা, শান্তি, সহানুভূতি, উদারতা ইত্যাদি মূল্যবোধ শিখতে পারে। তাই সাতটি ধর্মপ্রদেশ ও জাতীয় পর্যায়ে পরিবার উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় । পারিবারিক কাউন্সেলিং দ্বারাও অনেক সমস্যাগ্রস্ত পরিবারকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হচ্ছে।
৭। মানবাধিকার, ন্যায় ও শান্তিপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে: মানুষের মধ্যে ন্যায় ও শান্তির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মানুষের মনেই অন্যায় ও অশান্তি বারে বারে এসে দানা বাঁধতে থাকে। তাই ন্যায় ও শান্তি কমিশন সারা দেশে ঘনঘন প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সেমিনার পরিচালনা করে মানুষকে মানবাধিকার, ন্যায় ও শান্তি সম্পর্কে সচেতনতা দিয়ে থাকে।
৮। মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন ক্ষেত্রে : বর্তমান যুগের বড় একটা সমস্যা হলো মাদকাসক্তি। এটি এখন শুধু শহরের সমস্যাই নয়, গ্রাম-গ্রামান্তরেও এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। এই সমস্যা নিরসনের জন্য বাংলাদেশ মণ্ডলী বেশ কয়েক বছর যাবৎ অন্তত দুইটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছে। কেন্দ্র দুইটি হলো ‘আপন’ ও ‘বারাকা’। ইতোমধ্যে এগুলো যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে।
এসব সেবাকাজগুলোই শুধু নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও অনেক ধরনের সেবাকাজ হচ্ছে যেগুলো সব এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। মোটকথা, বাংলাদেশের খ্রিষ্টমণ্ডলী দেশ ও জাতি গঠনে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। মণ্ডলীর লক্ষ্য একটাই মানব সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা ।
খ্রিষ্টীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন সেবাকাজ করে যাচ্ছে।
তোমার এলাকায় দেশ ও জাতির উন্নয়নে কী কী সেবাকাজে অংশগ্রহণ করতে পার তা লেখ।
ক) বাংলাদেশে ___ বছরেরও আগে খ্রিষ্টমণ্ডলী স্থাপিত হয়েছে।
খ) তাই তারাও দেশের ___ রায় বদ্ধপরিকর।
গ) বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী ___ দিকে জোর দিয়েছেন।
ঘ) তাঁরা দেশের বহুস্থানে ___ গড়ে তুলেছেন।
ঙ) খ্রিষ্টমণ্ডলী চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর অনেক ___ দিয়েছেন।
ক) ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালও | ক) মাদকাসক্তি |
খ) বর্তমান যুগের বড় একটা সমস্যা হলো | খ) কাজ করে যাচ্ছে। |
গ) ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে অনেক খ্রিষ্টান | গ) অনুসরণ করা হয় । |
ঘ) খ্রিষ্টমণ্ডলী বাংলাদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য | ঘ) খ্রিষ্টান মিশনারীদের দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল। |
ঙ) মণ্ডলী পরিচালিত সারা বাংলাদেশে | ঙ) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। |
চ) ৪৮টি হাইস্কুল আছে। |
ক) বাংলাদেশে কতোজন খ্রিষ্টান নার্স রয়েছে?
খ) যুব উন্নয়নের জন্য কারা কাজ করেন?
গ) ন্যায় ও শান্তির জন্য কী করা হয়?
ঘ) বাংলাদেশে খ্রিষ্টমণ্ডলী পরিচালিত মাদকাসক্তি কেন্দ্র দুইটির নাম কী ?
ক) আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
খ) শিক্ষাসেবা ক্ষেত্রে খ্রিষ্টমণ্ডলীর অবদান কতোটুকু?